প্রতিদিন বাংলাদেশ, ঢাকা:
\\ প্রেম নিবেদন ও অশালীন আচরণে সংসার ভেঙেছে ভুক্তভোগী নারী এডিসির।
\\ সামাজিক ভাবে সমাধানের প্রতিশ্রুতিও রাখেননি ডিসি।
\\ ঢাকায় বদলি হয়ে আসার পরও গভীর সংকটে ভুক্তভোগী।
\\ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন।
জামালপুর ও দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নারী কেলেঙ্কারীর পর এবার ময়মনসিংহ বিভাগে কর্মরত একজন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) বিরুদ্ধে প্রেম নিবেদন ও অশালীন আচরণে গুরুতর অভিযোগ এনেছে তারই সহকর্মী নারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি)।
বিভিন্ন ভাবে নিজের ভালোলাগা ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে গিয়ে একপর্যায়ে সহকর্মীর (নারী কর্মকর্তা) জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলে ওই ডিসি। সংসার পর্যন্ত ভেঙে দিতে বাধ্য করে। তারপর সব শেষ।
পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা সুরক্ষার কথা চিন্তা করে দীর্ঘদিন বিষয়টি চেপে রাখলেও শেষমেশ অভিযুক্ত ডিসির বিচার দাবি করে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগী নারী কর্মকর্তা।
জেলা প্রশাসকের (ডিসি) বিরুদ্ধে গত ৪ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লেখা আবেদনপত্রের এক স্থানে উপসচিব পদমর্যাদার ওই নারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, বিভিন্ন সময়ে প্রেম নিবেদন করেন এবং নিজের কষ্টকর দাম্পত্য জীবনের জন্য সহানুভূতি প্রার্থনা করেন তিনি।
অনলাইনে, প্রকাশ্যে, জনসম্মুখে একাধিকবার তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। ওনাকে (ডিসিকে) সতর্ক করা সত্ত্বেও উনি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ব্যক্তিগত শালীনতাবোধ অতিক্রম করেন। দায়িত্বশীল আচরণ করতে বলা হলে উনি ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক নিুস্বাক্ষরকারীকে অন্যায় এবং মিথ্যা শোকজ করেন এবং হুমকি ধমকি দেয়ায় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হই।
অবমাননাকর পরিস্থিতিতে নারী কর্মকর্তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তার (ডিসি) অমানবিক এবং অসামাজিক আচরণের কারণে তার জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এর আগে এ বিষয়ে বিচার প্রার্থনা করে তিনি (নারী কর্মকর্তা) ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
সেখানে তিনি উল্লিখিত বর্ণনার পাশাপাশি এক স্থানে বলেন, এ পরিস্থিতিতে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপ প্রাপ্ত হয়েও উচ্চশিক্ষা গ্রহণে অপরাগ হই। অবমাননাকর পরিস্থিতিতে আমার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
পরবর্তী সময়ে তিনি সামাজিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো সুরাহা না করে টালবাহানা করছেন।
ভুক্তভোগী নারী কর্মকর্তা অভিযোগ দেয়ার ১১ দিন পর ১৫ মার্চ ডিসি অভিযোগকারী নারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ এনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর লিখিত দেয়।
সেখানে তিনি ৯ পৃষ্ঠার সংযুক্তিপত্র দিয়ে মূল বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করে, অভিযোগকারী কর্মকর্তা এডিসি (শিক্ষা) থাকাকালীন এসএমএস ও মেসেঞ্জার ব্যবহার করে ডিসিকে ছোটলোক, কীট, মিথ্যাবাদী, চরিত্রহীন ও লম্পটসহ অন্যান্য ঘৃণ্য ও মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।
এ বিষয়ে তাকে মৌখিক ভাবে সতর্ক করা হলে তিনি ভুল স্বীকার করেন এবং পুনরায় একই আচরণ করেন। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হলে বিষয়টি স্পর্শকাতর ও ব্যক্তিগত এবং ভুল বোঝাবুঝির কারণে অভিযোগসমূহ উত্থাপিত হয়েছে মর্মে নিঃশর্ত ক্ষমতা প্রার্থনাসহ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করেন।
অপর এক স্থানে তিনি (ডিসি) উল্লেখ করে, এ জাতীয় অপতৎপরতার ফলে নিম্নস্বাক্ষরকারীর পেশাগত, সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনের সুনাম ও শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ফলে তিনি (ডিসি) মানসিক ভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ওই কর্মকর্তার এ ধরনের অসংলগ্ন, মনগড়া ও কাল্পনিক বক্তব্য এবং প্রশাসনিক শিষ্টাচার ও রীতিবহির্ভূত আচরণ সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা ২০১৮ এর বিধি ২(খ)(ঈ) অনুযায়ী অসদাচরণের শামিল এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী নারী কর্মকর্তা বলেন, জুনিয়র অফিসার কেন, কোনো কর্মকর্তাই কখনও এ ধরনের শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমি তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা এডিসি হয়েও যদি তাকে (ডিসি) গালিগালাজ করে থাকি, তাহলে প্রশ্ন হল কোন পর্যায়ে গেলে ডিসিকে তার এডিসি এ ধরনের কথা বলতে পারেন? সেটি আগে বিবেচনায় নিতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখুন এ ঘটনার সঙ্গে শুধু আমার সামাজিক মর্যাদা নয়, আমার সার্ভিসের মর্যাদাও জড়িত। এ ছাড়া আমি তো কোনো ঠুনকো কেউ নই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে লেখাপড়া করেছি। ইংল্যান্ডেও পড়াশোনা করেছি। আমারও একটা প্রিভিয়াস বেটার ক্যারিয়ার আছে। কিন্তু একবার ভাবুন, আমার জীবন কতটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে আমি প্রায় ২ বছর পর লিখিত অভিযোগ দিতে বাধ্য হয়েছি।
তিনি বলেন, উনি তো ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে আমাকে নানা ভাবে ডিস্টার্ভ করা শুরু করে। সিনিয়র অফিসার হওয়ার কারণে প্রথম দিকে কৌশলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু উনি তো আমার ডিসি।
সরাসরি নিয়ন্ত্রণকারী সিনিয়র অফিসার। যখন তখন ডেকে পাঠাতো। কাজ না থাকলেও একরকম ওনার অফিস কক্ষে আমাকে বসিয়ে রেখে কথা বলতে চাইতেন। সব বলতে চাই না। বহুবার তাকে শৃঙ্খলা ও শালীনতাবোধ অতিক্রম করতে নিষেধ করেছি। কিন্তু তিনি শুনতেন না।
বদলি হতেও চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার কারণে বদলি হতে পারিনি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাফ জানিয়ে দিতেন, আমি খুব ভালো অফিসার। জেলার শিক্ষার মানোন্নয়নে আমাকে খুব বেশি প্রয়োজন। বদলি করা যাবে না।
কিন্তু যখন দেখলাম, তার কারণে আমার সংসার টেকানোই কঠিন হয়ে পড়েছে, তখন বাধ্য হয়ে বিভাগীয় কমিশনারসহ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কয়েকজন সিনিয়র অফিসারের কাছে মৌখিক অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি, বরং সেটি জানার পর তিনি আমাকে শোকজ করে মানসিক ভাবে আরও বিপর্যস্ত করে ফেলেন।
তিনি বলেন, গত বছর ৪ জানুয়ারি আমি শোকজ লেটার হাতে পাই। কেন এ ধরনের মিথ্যা হয়রানি করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি শোকজের অনুলিপি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো স্থগিত করেন।
কিন্তু ৮ জানুয়ারি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, মেসেঞ্জার দিয়ে ডিসি অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও বিভাগীয় কমিশনারের দফতরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ জানতে ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তার সঙ্গে তার দপ্তরে দেখা করি। তিনি বলেন, যেহেতু তুমি আমার বিরুদ্ধে স্যারদের কাছে মৌখিক অভিযোগ করেছ, তাই নিজেকে সেভ করার জন্য এটি আমাকে দিতে হয়েছে। সমস্যা নেই। চিন্তা করো না। আমি তোমাকে শোকজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেব। তুমি জবাব দাও। এরপর তিনি ভালোবাসার কথা বলেন।
তার দাম্পত্য জীবনের নানা সমস্যার কথা বলেন। আমাকে নানা ভাবে কনভিন্স করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, আমার সামনে বেটার ক্যারিয়ার। তুমি এনভাবে অভিযোগ করলে তো আমি বেশিদিন ডিসি থাকতে পারব না। আমাকে প্রত্যাহার করা হবে।
ভালো ক্যারিয়ারের জন্য কমপক্ষে ২ বছর ডিসি থাকতে হবে। আমাকে হেলফ কর, ইত্যাদি। ওনার কথামতো পরদিন ১০ জানুয়ারি শোকজের জবাব দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনাসহ অব্যাহতি চেয়েছি। কিন্তু তিনি কী ধূর্ত! আমার জবাব পাওয়ার পর সেটি তখন নিষ্পত্তি না করে ফেলে রাখেন। উল্টো শোকজের জবাবকে পুঁজি করে আমাকে পদে পদে জিম্মি করার চেষ্টা করেন।
ভুক্তভোগী কর্মকর্তা আরও বলেন, তার কারণে শেষ পর্যন্ত আমার সংসার ভেঙে গেল। চরম বিপর্যয় মাথায় নিয়ে বদলি হয়ে গত বছর জানুয়ারি মাসে সন্তানসহ ঢাকায় চলে আসি। ৭/৮ মাস তো ভীষণ ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছি।
এখনও সারাক্ষণ আমি বিষময় জীবন পার করছি। ঢাকায় এসে গত ১ বছর সন্তান নিয়ে সীমাহীন কষ্ট করেছি, যা জীবনে কোনো দিন করিনি। এর মধ্যে আমি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সুযোগও হাতছাড়া করে ফেলেছি। শুধু ওনার কারণেই। অথচ আমি যখন লিখিত অভিযোগ দিয়েছি, তার ২ সপ্তাহ পর তিনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ১ বছর আগে আমাকে দেয়া শোকজ এবং ওনার কথা মতো জবাব দেয়ার বিষয়টিকে হাতিয়ারে পরিণত করে উনি আমাকে ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। অথচ এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) ভালো দিয়েছে। প্রশ্ন হল, আমি যদি খারাপ হতাম তাহলে উনি এসিআর ভালো দিলেন কেন? এটিও তদন্তে আসা উচিত।
ভুক্তভোগী নারী কর্মকর্তা বলেন, আমি তো প্রায় সবই হারিয়ে ফেলেছি। সুন্দর, সাজানো গোছানো সংসার সব শেষ। এখন সন্তান আর চাকরিটা নিয়ে আছি। সিনিয়র স্যাররা নিশ্চয়ই সবদিক বিচার বিশ্লেষণ করে আমার প্রতি ন্যায়বিচার করবেন। যাতে ভবিষ্যতে কোনো নারী কর্মকর্তাকে আমার মতো এভাবে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে না হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ডিসি বলেন, পুরো বিষয়টি বানোয়াট, মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত।
জানতে চাওয়া হয়, ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক গড়ে না উঠলে একজন জুনিয়র অফিসার এ ভাবে ডিসিকে গালিগালাজ করতে পারে কি না। জবাবে ডিসি বলেন, বিষয়টি আমিও বুঝে উঠতে পারছি না। শোকজের জবাব নিষ্পত্তি করতে এক বছর সময় নিলেন কেন জানতে চাইলে ডিসি বলেন, সিনিয়র স্যারদের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হয়েছে।
ডিসির কাছে শেষ প্রশ্ন ছিল, ভিকটিম অভিযোগ করার পর আপনি অভিযোগ দিলেন কেন? আগেও তো দিতে পারতেন। উত্তরে তিনি বলেন, প্রশ্নটি উঠতেই পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমার অভিযোগ অসত্য।
সূত্র জানায়, ডিসি এবং এডিসির পাল্টাপাল্টি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিষয়টি তদন্ত করে প্রাথমিক রিপোর্ট দেয়ার জন্য ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নিরঞ্জন দেবনাথকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) নিরঞ্জন দেবনাথ বলেন, বিষয়টি তদন্ত পর্যায়ে আছে। এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। ভিকটিম সাক্ষী হিসেবে ১২ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর নাম পরিচয় উল্লেখ করেছেন। করোনার কারণে তাদের সাক্ষ্য নিতে একটু বিলম্ব হচ্ছে। এ সপ্তাহের মধ্যে তাদের বক্তব্য নেয়া হবে।
(তদন্ত প্রতিবেদন জমা না হওয়ার কারণে এ প্রতিবেদনে অভিযুক্ত কর্মকর্তার নাম ও বিস্তারিত পরিচয় উল্লেখ করা হল না)
ময়মনসিংহের ডিসি সাহেবের বিরুদ্ধে এডিসির উত্থাপিত অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে তদন্তে প্রমাণিত হলে ডিসি সাহেবকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা সমীচীন হবে। ভুক্তভোগী এডিসি সংক্ষুব্ধ হলে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন।